আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, মে ৩০, ২০২৩

শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের আন্দোলনের পেছনে গভীর বিভেদ

661813_175

‘দেখুন এখানে মুসলিমরা রয়েছে, হিন্দুরা রয়েছে, ক্যাথলিকরা রয়েছে। তাদের সবার শরীরে এক রক্ত। এটাই প্রকৃত শ্রীলঙ্কা।’

রাজধানী কলম্বোর সাগর তীরে গল ফেস গ্রিন চত্বরের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন লাকশান ওয়াত্তুহেওয়া। বিশাল সবুজ ওই চত্বরে সেসময় কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ-সমাবেশ চলছিল।

ওয়াত্তুহেওয়ার আশা, নজিরবিহীন অর্থনৈতিক দুর্দশার জেরে যে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে তাতে শ্রীলঙ্কায় কয়েক দশকে ধরে চলা ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভেদ, বৈষম্য, সহিংসতা দূর হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

পাশে দাঁড়ানো একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ওয়াত্তুহেওয়ার কথার সাথে একমত হয়ে মাথা নাড়লেন। মানুষ সম্প্রদায় এবং ধর্ম বিভেদ ভুলে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কা এখন এক এবং ঐক্যবদ্ধ দেশ।

এই দুজনই শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ যারা এ দেশের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ হচ্ছে মুসলিম, তামিল হিন্দু ও খ্রিষ্টান।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পুরো শ্রীলঙ্কা জুড়ে মানুষজন রাস্তায় নেমে একটি স্লোগানই দিচ্ছে : গোটা বাড়ি চলে যাও। গোটা হচ্ছেন গোটাবায়া রাজাপাক্সা, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট।

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ছাড়াও, রাজাপাক্সা সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

সমালোচকরা বলছেন, রাজাপাক্সা তার রাজনৈতিক স্বার্থে শ্রীলঙ্কার দীর্ঘ দিন ধরে চলা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদ এবং উত্তেজনাকে আরো উস্কে দিয়েছেন। তিনি নিজের মুখেই বলেছিলেন, আমি জানতাম, শুধু সিংহলিদের ভোটেই আমি এই নির্বাচন জিততে পারি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি শ্রীলঙ্কায় নতুন কিছু নয়। ঐতিহাসিকভাবে এই রাজনীতির প্রধান টার্গেট হয়েছে তামিল হিন্দু সম্প্রদায়।

শ্রীলঙ্কায় ২০০৯ সালে যখন তামিল টাইগার বা এলটিটিই'র কয়েক দশকের সশস্ত্র বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করা হয়, তখন গোটাবায়া রাজাপাক্সা ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

সিংহলি জনগোষ্ঠীর অনেকেই সেসময় তাকে জাতির নায়ক বলে বন্দনা করেছে। যদিও যুদ্ধের সময় তার বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ উঠেছে।

তার সমালোচকরা বলেন, বিদ্রোহ দমনের পরও তিনি দেশের সংখ্যালঘু তামিল সম্প্রদায়কে আস্থায় নেয়ার কোনো চেষ্টা করেননি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদ এবং অহংকে উসকে দিয়েছেন তাতে তামিলরা নিজেদেরকে দ্বিতীয়-শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে মনে করতে শুরু করে।

তারপর ২০১৯ সালে ইস্টারের সময় সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলিম জনগোষ্ঠীও সিংহলি জাতীয়তাবাদের রোষানলে পড়ে যায়। দুর্বিসহ হয়ে পড়ে তাদের জীবন।

মুসলিমদের বাড়িঘর, জীবিকা টার্গেট করে ব্যাপকহারে হামলা হয়েছে। মুসলিমদের পক্ষে মোৗলিক অধিকার নিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, বলেন শিরিন সারুর, সুপরিচিত মুসলিম অধিকার আন্দোলনকারী।

সিংহলি বৌদ্ধ নেতারা মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দিয়েছেন। প্রকাশ্যে মুসলিমদের ওপর হামলার উস্কানি দেয়া হয়েছে এবং অনেক হামলা হয়েছে।

এছাড়াও মুসলিম বিদ্বেষ যে এখন কতটা প্রাতিষ্ঠানিক তা কোভিড প্যানডেমিকের সময় নেয়া সরকারের নীতিতে প্রকাশ হয়ে পড়ে, বলছেন শিরিন সারুর।

লাশ পোড়ানো মুসলিম ধর্মে নিষিদ্ধ জেনেও জবরদস্তি করে কোভিডে মৃত মুসলিমদেরও দাহ করা হয়েছে।

ফলে, কলম্বোর গল ফেস গ্রিনের সমাবেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের লোকজনের যে উপস্থিতি চোখে পড়েছে তা প্রেসিডেন্ট রাজাপাক্সার বিভেদের রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের একটি প্রতিফলনও বটে।

কিন্তু অনেক বিশ্লেষক সতর্ক করছেন যে ব্যাপারটি অত সোজাসাপ্টা নয়।

কোনো সন্দেহ নেই যে ব্যতিক্রমী একটি সময়ের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা, বলেন কলম্বোতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের সিনিয়র গবেষক ভবানি ফনসেকা।

কিন্তু এখন যা দেখা যাচ্ছে তা যে সমাজে একটি সত্যিকারের একটি অগ্রগতির সূচনা করবে সে কথা এখনই বলা যাবে না। কিছু দিন আগেও এই সরকারের যারা কট্টর সমর্থক ছিলেন তাদের অনেকেই এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। এটা নিয়ে সংখ্যালঘুরা নিশ্চিতভাবে কিছুটা সন্দিহান।