আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, মে ৩০, ২০২৩

কী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর সামনে?

20220409_ASP504

শেষ পর্যন্ত গদি রক্ষা করতে পারলেন না পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান। বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে হেরে গেলেন তিনি। ক্ষমতায় থাকতে সব চেষ্টাই করেছিলেন তিনি, কিন্তু অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ও বিরোধীদের ভোটের মুখে টিকতে পারেননি।

পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলেন ইমরান। ক্ষমতায় তার শেষ দিনটিও ছিল বেশ নাটকীয়। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, অনাস্থা ভোট বন্ধ করে দেওয়া আইনবিরোধী ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শনিবারের মধ্যে অনাস্থা ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবুও দিনের বেশিরভাগ সময় ইমরানের সহকর্মীরা ভোটে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তিনবার অধিবেশন স্থগিত করা হয়। বিরোধীদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পাক সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আস্থা ভোট না হলে ইমরান খান, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। চাপের মুখে নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ করেন স্পিকার আসাদ কায়সার ও ডেপুটি স্পিকার কাশিম সুরি। এরপর পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির চেয়ার প্যানেলের সদস্য আয়াজ সাদিক স্পিকারের দায়িত্ব নেন। এরপর রোববার ভোর রাতে ১৭৪-০ ভোটের ব্যবধানে অনাস্থা ভোটে হেরে যান ইমরান খান।

পরিস্থিতি যেদিকেই এগোক, প্রায় নিশ্চিত পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যিনিই হবেন এর মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের আগের ধারা ফিরে আসবে। ইমরান খানের উত্তরসুরী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরীফ প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান। আবার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি। বিলওয়াল ভুট্টো জানিয়েছেন এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য শাহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হোক চান তিনি। 

৭০ বছর বয়সী শাহবাজ শরিফের তার ভাইয়ের মতো ক্যারিশমা নেই। ভাতিজি মারিয়াম নেওয়াজ শরীফের মতো জনসমাগম করার সেই ক্ষমতাও নেই। তার দক্ষতা প্রশাসনিক কাজে। ধনী শিল্পপতির ছেলে শাহবাজ রাজনীতিতে প্রবেশের আগে বিশ্ববিদ্যালয় শেষে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছিলেন। তার ভাই ছিল দেশটির তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, আর তিনি তিনবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। পাঞ্জাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগ করে তার প্রশাসন। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় নেওয়াজ শরীফের শাসনের অবসান হয়, দুই ভাই-ই সাময়িকভাবে রাজনীতির মাঠে ছিলেন না এরপর। ভাইয়ের মতো শাহবাজ শরীফের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তবে তাদের বক্তব্য এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত। বর্তমানে অর্থ পাচার মামলার জামিনে আছেন তিনি। তবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

তিনিই যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তার যোগ্যতা ও খ্যাতির পরীক্ষাও হয়ে যাবে। বর্তমানে অথৈ সাগরে পাকিস্তানের অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ১৩ শতাংশে।

তার ভাইকে দেখে হয়তো শাহবাজ বুঝতে পেরেছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে টেক্কা দিতে দেশটির রাজনীতিবিদরা বিপাকে পড়েন। তার ভাই নেওয়াজ ও নেওয়াজের মেয়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও, এদিক দিয়ে অনেকটাই সমঝোতামূলক আচরণ করেন শেহবাজ। সেনাবাহিনীও তাকেই তার দলের একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনে করে।

দেশটির বৈদেশিক সম্পর্কের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। নতুন সরকারকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তপ্ত আঁচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। পাকিস্তানের বিভিন্ন ঘটনার জন্য দায় পড়া আমেরিকার জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে ক্ষমতায় থাকাকালীন আমেরিকার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতো পিপিপি, ক্ষমতায় এলে এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে তারা। ফলে, ইমরান খান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে ক্ষতি করেছিল তা হয়তো ক্ষণস্থায়ীই হবে। 

তবে, পাকিস্তানের প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শাহবাজের খুব বেশি কিছু করার নেই। ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের নীতি নির্ধারণ করেই রেখেছে সেনাবাহিনী। গত ২ এপ্রিল জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বলেছিলেন, বিতর্কিত কাশ্মির ইস্যুতে সংলাপ  চালাতে ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত তারা।

তবে আফগানিস্তান সংকট আরও জটিল। পশ্চিমাদের সঙ্গে তালেবানের সংলাপে পাকিস্তান চেষ্টা করে গেলেও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন তারা। গত বছর তালেবানের বিজয় জাগিয়ে তুলেছে পাকিস্তানের জিহাদি গ্রুপকেও। পাকিস্তানও এখনো স্বীকৃতি দেয়নি তালেবান সরকারকে। তবে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে তাদের সাথেই সম্পর্ক ভালো তালেবানের। তালেবানকে মোকাবিলার জন্য পাকিস্তানকেই মধ্যস্ততাকারী হিসাবে দেখে পশ্চিমা দেশগুলো। তবে এই যোগাযোগও সীমিত এহকন পর্যন্ত, তালেবানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে পশ্চিমা দেশগুলোর।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকেও মোকাবিলা করতে হবে শাহবাজের। তবে বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে চীণ-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন শাহবাজ ও নওয়াজ। চীনা সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইমরানের আমলে ওই প্রকল্পের কাজ বেশ ক'বার পিছিয়ে পড়ে।

যা-ই হোক না কেন, পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর যাত্রাও সহজ হবে না। বিজয়ের মুহূর্তে হয়তো তার দল ঐক্যবদ্ধ হবে, কিন্তু তাও খুব বেশিদিন টিকে থাকবে না। শাহবাজের ভাতিজা, নওয়াজের মেয়ে মারিয়ামকে দীর্ঘদিন থেকেই তাদের পরিবারের সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী মনে করা হয়। মারিয়ামও হয়তো খুব বেশিদিন চুপচাপ বসে থাকবেন না। ২০২৩ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, কিন্তু তারিখ আরও এগিয়ে আনার সম্ভাবনা আছে। সামনেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাটকীয়তা চলতেই থাকবে।