আমরা লাইভে English বুধবার, জুন ০৭, ২০২৩

প্রণবদা ভারতের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রীত্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি

SAM SPECIAL 2020-09-01 080242

ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি সোমবার দিল্লী হাসপাতালে মারা যান। সেখানে মাথায় সার্জারি করা হয়েছিল তার। তার বয়স হয়েছিল ৮৪। ‘প্রণবদা’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী-যুগের সবশেষ ক্ষমতাধর নেতার প্রস্থান হলো। এমন সময় তিনি চলে গেলেন যখন তার দল এমন একজন ব্যক্তির খোঁজ করছে যিনি কি না দলের সবগুলো ভেঙ্গে যাওয়া অংশকে জোড়া দিতে পারবেন এবং তাদের মধ্যে উৎসাহের আগুন জ্বালাতে পারবেন। 

১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিম বঙ্গের বিরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রণবদা। ভারতীয় রাজনীতি আর শাসন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তনের প্রকৌশলী হিসেবে তাকে স্মরণ করা হবে। অনেক মাইলফলক সিদ্ধান্তের পেছনে তার ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেই ভাবনাটা সবসময় ফিরে ফিরে আসবে, সেটা হলো প্রধানমন্ত্রীর পদের কাছাকাছি তিনি কতবার গেছেন কিন্তু প্রত্যেকবারই সেটা ফসকে গেছে। 

প্রণবের বাবা কামাদা কিনকার ছিলেন তার নিজের ভাষাতেই - একজন ‘কট্টর জাতীয়তাবাদী’ – এবং নিজের সন্তানদেরকে তিনি স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে একটা শৃঙ্খলা আর দেশপ্রেমের মধ্যে বড় করেছেন। 

আত্মজীবনীর প্রথমাংশ – দ্য ড্রামাটিক ডেকেড – এ মুখার্জি লিখেছেন “কংগ্রেস যখন ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিলো, তখন প্রতি বছর আমাদের বাড়িতে পতাকা ওড়ানো হতো”।

মজার ব্যাপার হলো কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের মধ্যে বড় হওয়া মুখার্জি ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখন তিনি কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে আসা বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন অজয় মুখার্জি। ১৯৬৯ সালে তিনি কমিউনিস্টদের সমর্থন নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্য সভায় যান। আসলে পশ্চিম বঙ্গের দীর্ঘতম সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাকে রাজ্যসভায় পাঠানোর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার একটা কারণ ছিল। 

মুখার্জি অজয় মুখার্জিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বাংলা কংগ্রেসের উচিত বাম দলগুলো বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সিস্টের (সিপিআই-এম) সাথে জোট বাঁধা, যাতে কংগ্রেসকে পরাজিত করা যায়। মুখার্জি লিখেন: “ধারণাটা প্রথমে আমিই দিই.. আমরা যদি অভিন্ন জায়গা থেকে (পশ্চিম বঙ্গে) নির্বাচন করি, তাহলে আমরা কংগ্রেসকে হারাতে পারবো”।

ইন্দিরা গান্ধী তাকে পছন্দ করেছিলেন, বিশেষ করে পার্লামেন্টে তার বক্তৃতার কারণে। ১৯৭৩ সালে কংগ্রেস আর বাংলা কংগ্রেস এক হয়ে গেলে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। তখন ডেপুটি মন্ত্রী হন তিনি। 

রাজ্য সভার সদস্য দেব প্রসাদ রায় বলেছিলেন, “দিল্লীতে আপনাকে সমর্থন দেয়ার মতো আপনার জাতের কেউ নেই, উত্তর প্রদেশ বা অন্যান্য হিন্দুপ্রধান রাজ্যগুলো থেকে নির্বাচিতরা যে সুবিধাটা পেয়ে থাকেন। কিন্তু প্রণব দ্রুত ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে যান, মূলত তার ধারালো চিন্তার কারণে”। রায় আরও বলেন, যে কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে মুখার্জির স্মৃতি আর সামর্থ্য ছিল ‘অসামান্য’। 

অন্ধকার দিনগুলো

১৯৮৬ সালে মুখার্জিকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। মুখার্জির সাথে ছিলেন সুখেন্দু শেখর রায়। তিনি বলেন: “সময়টা ছিল খারাপ। প্রণবদা রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গঠন করেন এবং ১৯৮৭ সালে পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনে ২০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তিনটি ছাড়া সব কটি আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। দাদা খুবই হতাশ হয়ে পড়েন”।

মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা ২০১৯ সালের আগস্টে পরলোকগমন করেন। তার জীবনী লিখেছেন সংগীতা ঘোষ। তিনি ওই দিনগুলোকে বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে: “আমরা দুর্গাপুরে থাকতাম। আমার বাবার বন্ধু মুখার্জি আমাদের বাড়িতে আসতেন। সাধারণত তাকে দেখতাম প্রাণোচ্ছ্বল। কিন্তু ওই সময়টা ছিল অন্য রকম। তার সাথে কেউ ছিল না এবং তিনি ছিলেন একাকি আর হতাশ। রাজনীতি আর দলে নিজের সহযোগীদের অভাব বোধ করছিলেন তিনি”।

১৯৮৮ সালে আবার কংগ্রেসে ফিরে যান মুখার্জি। কিন্তু তার দীর্ঘদিনের বন্ধু পি ভি নরসীমা রাও যখন ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তিনি অপ্রত্যাশিত মুখার্জির সাথে দেখা করতে আসেন। “প্রণবদা খুবই হতাশ ছিলেন। তাকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন হিসেবে যোগ দিতে বলা হয়। অনিচ্ছার সাথে তিনি দায়িত্বটা নেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি মন্ত্রিসভায় ফিরে যান। 

বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ

প্রণব মুখার্জি আর বাংলাদেশ ছিল অবিচ্ছেদ্য। অবিভক্ত ভারতের রাজনীতি থেকে উৎসারিত মুখার্জি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির উপর আগ্রহের সাথে নজর রাখতেন। এই আগ্রহই তাকে বাংলাদেশের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

প্রায় ১৫ বছর আগে মুখার্জি এই সাংবাদিককে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “বাংলাদেশ আমার কাছে কূটনীতি বা রাজনীতির ব্যাপার নয়। এই জায়গাটা আমার প্রিয়”। সম্ভবত এই কারণেই তার আত্মজীবনীর প্রথম অধ্যায়টি লেখা বাংলাদেশকে নিয়ে: ‘মুক্তিযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্ম’।

মুখার্জি লিখেছেন: “১৫ জুন (১৯৭১) বাজেট অধিবেশনের সময় রাজ্যসভায় একটা আলোচনার উত্থাপন করেছিলাম আমি। বলেছিলাম যে ভারতের উচিত মুজিবনগরের নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারকে কূটনীতিক স্বীকৃতি দেয়া। এক সদস্য আমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করেছিল যে, কিভাবে এই সমস্যা মোকাবেলা করা যাবে। জবাবে আমি বলেছিলাম: আমি একটা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছি, যার অর্থ হলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয়া”।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনার পরিবারকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তারা ভারতে চলে আসেন এবং মুখার্জি এবং তার স্ত্রী শুভ্রা পাঁচ বছরের জন্য তাদের আশ্রয়দাতা ও অভিভাবক ছিলেন। এই যোগাযোগ বজায় ছিল এবং দুই দেশকেই সাহায্য করেছে, এবং আরও পরে কংগ্রেস আর আওয়ামী লীগকেই সেটা সাহায্য করেছে। 

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেছেন: “মুখার্জির পরিশীলিত পরিপক্কতা ছিল। কূটনীতিতে সবসময় অগ্রগতি আশা করা হয় না, বরং এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সতর্কতার সাথে শব্দ ব্যবহার করা। ভারতীয় পক্ষ থেকে এখন আমরা যেমনটা প্রত্যক্ষ করি, মুখার্জি সেই তুলনায় অনেক বিনয়ী ছিলেন”।

কৌতুহলের ব্যাপার হলো, দুই দেশের সম্পর্কের যখন নতুন করে অবনতি হয়েছে, তখন বাংলাদেশের অনেকেই মুর্খাজি আর তার অনুরাগের কথা স্মরণ করেছেন।

সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ি বহু দশক ধরে মুখার্জিকে ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং একটা জীবনী লিখেছেন তিনি। তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে মুখার্জি একটা ‘গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল’ ভূমিকা পালন করেছিলেন। নোবেল বিজয়ী মোহাম্মাদ ইউনূসকে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কেন তার রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া উচিত এবং বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেয়া উচিত। লাহিড়ি বলেন, “ইউনূসকে সমর্থন দেয়ার আমেরিকান অনুরোধে তিনি সাড়া দেননি”।

ইউপিএ’র দিনগুলো

অন্তত চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল প্রণব মুখার্জির। ১৯৮৪ সালে, পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। ২০০৪ সালে যখন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) প্রথম পরে ইউপিএ দ্বিতীয় সরকার ক্ষমতায় আসলে, তখনও তিনি বাদ পড়েন। গান্ধীরা তার পক্ষে ছিলেন না (যদিও সোনিয়া গান্ধী ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য তাকে একবার সমর্থন দিয়েছিলেন)। 

সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, “সোনিয়া ছিলেন আন্তরিক। কংগ্রেস বেশ কিছু কেলেঙ্কারির কারণে প্রচণ্ড চাপে ছিল এবং কংগ্রেসের একটি অংশ মত দিয়েছিল যাতে প্রণবকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়, কারণ তিনি পুরোপুরি কালিমামুক্ত এবং যাতে এটা ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাবকে কমিয়ে আনতে পারে, আর মনমোহন সিংকে প্রেসিডেন্টের পদের জন্য বাছাই করা যেতে পারে। কিন্তু কেন এই পরিকল্পনা কাজ করেনি, আমি সেটা জানি না, কারণ ২০১১ সালে আমি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিই”।

মুখার্জি কেন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি সেটা একটা রহস্যই রয়ে গেছে। একটি গুঞ্জন ছিল যে, সিংকে যদি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য বাছাই করা হয়, তাহলে তিনি হয়তো প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট পেতেন না, যেটা মুখার্জি পাবেন। মুখার্জি সেটা পেয়েছিলেন – সব দল, পক্ষ, বিরোধীদের ভোট তিনি পেয়েছিলেন। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেলে তাদের মুখরক্ষার জন্য সেটা হতো খুবই ক্ষতিকর এবং সমস্যায় জর্জরিত দলটির জন্য ক্ষমতায় থাকাটাই কঠিন হয়ে যেতো। SAM SPECIAL 2020-09-01 080242.jpg2

জীবনের শেষ দিকে মুখার্জি হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) নাগপুর সদরদপ্তরে যাতায়াত করেছেন, যেটা কংগ্রেসকে ক্ষুব্ধ করেছে। তার দল কার্যত তার সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে, এবং আবারও তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তিনি ভারতরত্ন উপাধি পেয়েছেন বিজেপি সরকারের কাছ থেকে। সম্ভবত আরএসএস সদর দপ্তরে যাতায়াতের কারণেই সেটা তাকে দেয়া হয়েছে। আরএসএসের শীর্ষ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। 

এভাবেই, মুখার্জি কংগ্রেসের বিরোধী বিভিন্ন দলের সরাসরি ও পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু ও শেষ করেন। কিন্তু কংগ্রেসে যতদিন ছিলেন, দলের প্রতি অনুগত ছিলেন তিনি। 

তার মৃত্যুতে বহু পুরো কংগ্রেস সমর্থক ও নেতাদের এটা মনে হয়েছে যে, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব শেষে কংগ্রেসে যদি আরও পাঁচ বছর তিনি থাকতেন, তাহলে দুর্বল এই দলটাকে হয়তো তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে পারতেন।