মোদির সহযোগীরা ভারতের মুসলিমদের বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের ব্যাপারে মোদির ধারণা কি

মুসোলিনি তার ছেলের কাছে বলেছিলেন যে, একটা দুঃস্বপ্ন তাকে সবসময় তাড়া করে। সেটা হলো মিত্র বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে তার বিচার করা হবে। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদির কল্পনা ছিল সেই ম্যাডিসন স্কয়ারে বিজয় সমাবেশ করা। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সেই সমাবেশ তিনি করেছিলেন। ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা ছড়ানোর অভিযোগে যে মোদিকে একসময় ভিসা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৪ সালে এসে সেই যুক্তরাষ্ট্রেরই অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন করেন মোদি। সেখানে তাকে স্বাগত জানায় তার প্রায় ২০ হাজার সমর্থক। এর পর থেকে ‘হাউডি মোদি’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্পের’ মতো আয়োজন করে আমেরিকাকে যেন দ্বিতীয় ঘর বানিয়ে ফেলেছেন মোদি, আর ট্রাম্পকে বানিয়েছেন বন্ধু। দুটো প্রাচীন সভ্যতার যেমন এখানে মিলন ঘটেছে, একইভাবে মিলন ঘটেছে দুটো দেশের, চলমান কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় যারা উভয়েই দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
করোনাভাইরাস মোদির আমেরিকান কল্পনাবিলাসকে হয়তো খানিকটা থমকে দিয়েছে, কারণ আমেরিকা ত্যাগ করা বা ভারতে প্রবেশ করা দুটোই এখন খুবই কঠিন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানরত মোদির হিন্দু ডানপন্থী সমর্থকরা থেমে থাকেনি। এই গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছে আমেরিকান ইন্ডিয়ান পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি)। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, বুধবার ৫ আগস্ট টাইমস স্কয়ারে অতিকায় ডিজিটাল স্ক্রিন ভাড়া নেয়া হবে এবং পুরোটা দিন সেখানে হিন্দু দেবতা রাম এবং ভারতে যে রাম মন্দিরের নির্মাণকাজের উদ্বোধন হচ্ছে, সেটা এই স্ক্রিনে দেখানো হবে।
এই পরিকল্পনার পক্ষে বিপক্ষে সমাবেশ হয়েছে। এবং টাইমস স্কয়ারের হাই-প্রোফাইল নাসদাক স্ক্রিনে যদিও মন্দিরের ছবি প্রচারের পদক্ষেপ সফল হয়নি, তবে হারশিজের দোকানের একটি ডিজিটাল বোর্ডে মন্দিরের ছবি দিনের একটা সময় ধরে প্রচার করা হয়েছে। মন্দিরের ছবিটি যখন বিশাল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, টাইমস স্কয়ারে ‘ভারতীয় কমিউনিটির’ লোকেরা তখন মিষ্টি বিতরণ করে। এই ঘটনায় বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ থেকে শহরের মেয়র এবং বিলবোর্ড মালিকের কাছে প্রতিবাদ ও আপত্তি জানানো হয়েছে। তাদের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে অধিকাংশ বড় স্ক্রিনে মন্দিরের ছবি প্রচার বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু রাম মন্দিরের সাময়িক প্রচারিত এই ছবিতে যতটুকু না প্রকাশিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি গোপন রয়ে গেছে।
মন্দির নির্মিত হচ্ছে ভারতের অযোধ্যা শহরে। যেখানে মন্দির নির্মিত হচ্ছে, সেখানে একসময় মসজিদ ছিল, যেটাকে ধ্বংস করে উগ্রপন্থী হিন্দুরা। এই ধ্বংসের ঘটনা ঘটে দীর্ঘ দিনের প্রচারণার পর। এত সফলভাবে একটা কল্পিত ক্ষোভ সৃষ্টি করা হয় যে, রাজনৈতিক চরম প্রতিকূলতার জায়গা থেকে সেই প্রচারণা বিজেপিকে আজকের ব্যাপক জনপ্রিয় সরকার গঠনের জায়গায় নিয়ে এসেছে।
এই মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দাঙ্গা হয়েছে এবং এতে প্রায় ২০০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই মুসলিম। মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারটা এরপর ভারতের নিত্যদিনের বিষয় হয়ে গেছে। ২০০২ সালে গুজরাটে যে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়, সেখানেও এক হিন্দু তীর্থযাত্রীর মৃত্যুর বিষয় জড়িত ছিল, যিনি অযোধ্যা থেকে মসজিদ ধ্বংসের বার্ষিকী উদযাপন করে গুজরাটে ফিরছিলেন।
মুসোলিনি ছিলেন পুরনোকালের ফ্যাসিবাদী যিনি একটা ‘খাঁচায় বন্দি হিংস্র প্রাণীর’ মতো মানুষের সামনে হাজির হতে ভয় পেতেন। কিন্তু মোদি অনেক চালাক। তিনি জানেন হিংস্র প্রাণীকে কিভাবে ছেড়ে দিতে হয় এবং কিভাবে তাদেরকে বিশ্বের সামনে গ্রহণযোগ্য করতে হয়। একদিকে নিউ ইয়র্কে তার প্রদর্শনী চলছে, অন্যদিকে কাশ্মীর, অযোধ্যাসহ ভারতের অন্যান্য জায়গায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার বর্বরতাও জারি আছে। এই প্রক্রিয়া যাতে দায়মুক্তির সাথে পার পেতে না পারে, সে জন্য পশুকে খাঁচায় বন্দি করাটা জরুরি। বিশ্বের অন্যতম বৈচিত্রপূর্ণ একটা শহরে এভাবে ঘৃণা ছড়াতে দেয়া কোনভাবেই উচিত নয়।