ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: পশ্চিমা গণমাধ্যমের সুর পরিবর্তন
যুদ্ধে রাশিয়া কীভাবে ইউক্রেনের হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সমানে তা প্রচার করে গেছে। পাশাপাশি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া কেমন বিপর্যয়ে পড়েছে তাও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। তবে যুদ্ধ যত পুরনো হচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের লেখায়ও বেশ বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা কী আদৌ কাজ করছে? প্রধান মিডিয়াগুলোই এখন বলছে, রুশ অর্থনীতি আঘাতপ্রাপ্ত হলেও সেটি মোটেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না, বরঞ্চ পশ্চিমা দেশগুলোও এখন ভুগতে শুরু করেছে।
যুদ্ধের প্রথম থেকেই ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’ কিংবা ‘স্নেক আইল্যান্ড ১৩’ এর মতো ঘটনা প্রচার হয়েছে। ইউক্রেনীয়দের মনোবল বৃদ্ধিই ছিল এসব গল্প তৈরির উদ্দেশ্য। তবে এখন পশ্চিমা গণমাধ্যম তাদের রিপোর্টের ধরনে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। যুদ্ধে আসলে কে জিতছে এবং রাশিয়ার অর্থনীতি আসলে কতটা ভুগছে তা উঠে আসছে বিভিন্ন রিপোর্টে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একতরফাভাবে ইউক্রেনকে সমর্থন দেয়া উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে আসছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বৃটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের ইকোনমিক এডিটর ল্যারি এলিয়টের একটি লেখার কথা। তার ওই লেখার শিরোনাম ছিল, ‘রাশিয়া অর্থনৈতিক যুদ্ধে জিতে যাচ্ছে এবং পুতিন শিগগিরই সেনা প্রত্যাহার করছেন না’। এতে এলিয়ট বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে গত তিন মাস ধরে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব।
কিন্তু পশ্চিমাদের পরিকল্পনা কাজ করছে না। বরঞ্চ পরিস্থিতি উল্টো তাদের জন্য খারাপ হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা যে কাজ করছে না তার প্রমাণ হিসেবে এলিয়ট মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইউক্রেনকে রকেট পাঠানোর ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমাদের সামনে এখন একমাত্র আশা, ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি দেয়া হলে হয়তো রাশিয়া পিছু হটতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক যুদ্ধে যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি, সেটি অর্জনে এখন সামরিক পথ বেছে নিচ্ছে পশ্চিম।
গত ৩০শে মে গার্ডিয়ানের কলামিস্ট সাইমন জেনকিনসও রুশবিরোধী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে একই কথা বলেছেন। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক লেখায় তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখন নিষেধাজ্ঞার কথা ভুলে যাওয়া উচিত কারণ এটি ভালোর চেয়ে খারাপই করছে। নিষেধাজ্ঞা দিলে রাশিয়া সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হবে এমন চিন্তা কতটা অযৌক্তিক, তা সাইমনের লেখায় উঠে এসেছে। তবে তিনি ইউক্রেনকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পক্ষে মতো দিয়েছেন। পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথাও বলেন তিনি। এগুলোকে তিনি ইউরোপের জন্য আত্মঘাতী এবং নির্মম বলে আখ্যায়িত করেন।
সাইমন তার লেখায় বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বিশ্বে তেল ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এতে রাশিয়ার আয় কমার থেকে উল্টো বাড়ছে। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলো খাদ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে ইউক্রেনকে সাহায্য করে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। যদিও রাশিয়ান সেনারা ডনবাসে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি তার লেখায় উঠে আসেনি।
তবে গত ২৬শে মে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি রিপোর্টে ইউক্রেনের সেনাদের দুরাবস্থার কথা উঠে আসে। দিনে একটি আলু খেয়ে ইউক্রেনীয় সেনারা কীভাবে যুদ্ধ করছে সেটি প্রকাশ করা হয় ওই রিপোর্টে। এতে জানানো হয়, সেভেরোদনেতস্কের কাছে একটি ইউক্রেনীয় ইউনিট অর্ধেকেরও বেশি সেনা হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের সঙ্গে কথা বলায় ওই ইউনিটের সদস্যদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিপর্যয়কর অবস্থার কথা উঠে এসেছে টেলিগ্রাফের ডিফেন্স এডিটর কন কাফলিনের লেখায়ও। তিনি যদিও নিয়মিতভাবে রাশিয়ার পরাজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছিলেন। তবে এখন তিনি বলছেন, ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র না দিলে মস্কো যুদ্ধে জয়ী হতে পারে। এছাড়া তার সর্বশেষ লেখায় তিনি বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাতে পুতিন ইউক্রেনে জয় পেতে দ্বিতীয় আরেকটি সুযোগ পেয়েছেন। এদিকে দ্য ইকোনমিস্ট আরও প্রায় এক মাস আগেই জানিয়েছিল যে, নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি। কিন্তু উল্টো পশ্চিমা বিশ্বকে এখন জ্বালানি সংকটের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। তাদের জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে এবং রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ানদের গ্যাস সংকট দেখা যাচ্ছে না, যাচ্ছে মার্কিনিদেরই। গত ১৯শে মে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এডিটোরিয়াল বোর্ড এক কলামে লিখেছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের নিশ্চিত জয় কোনো ‘বাস্তবিক লক্ষ্য’ নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উচিত জেলেনস্কিকে বলা যে, যুক্তরাষ্ট্র কতখানি সাহায্য করতে পারবে তার একটা সীমা আছে।